নৌকার উপর দন্ডায়মান একজন তাগড়া জোয়ান। বয়স চল্লিশশের কাছাকাছি। সুঠাম স্বাস্থ্য। শরীরে কঠোর পরিশ্রমের চিহ্ন। জোয়ান বেশ কর্মঠ ও শক্তিশালী। গায়ে তার একটি হাফ হাতা পাতলা সুতি গেঞ্জি। পরনে একখানা লুঙ্গি হাঁটু অবধি উঁচু করে বেশ গুছিয়ে পরা। জোয়ানের প্রশস্ত কাঁধের উপর পাতানো চওড়া বাঁশের বাঁখারি। বাঁখারির দুই প্রান্তে ঝুলানো চারটি করে লম্বা রশি। রশির মাথায় বাঁধা প্রকাণ্ড দু’খানা বাঁশের ঝুড়ি। ঝুড়ি ভর্তি কাঁচা তরিতরকারি। ঘামে ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে জোয়ান। অল্প সংখ্যক যাত্রী। নৌকাটা দুলছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টায় রত। নৌকাটা আবারো দুলে উঠল। কিন্তু এই জোয়ান কাঁধ হতে বাক সমেত বোঝা নামালনা। পায়ে জুতা নেই। নগ্ন আদুল পায়ে লেগে থাকা পথের ধুলায় দূর পথ অতিক্রমের চিহ্ন। কাঁধের মোটা চামড়ায় দগদগে ক্ষতের দাগ। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই জোয়ানের। যে কেউ দেখে বলবে শক্তিশালী পুরুষ। তাকে মহাপুরুষ বলা না গেলেও সুপুরুষ বা বীরপুরুষ বলা চলে। দুলতে দুলতে খেয়া নৌকা খানা ওপারের ঘাটে এসে ভিড়লো। নৌকার গলুই হতে চরের নরম মাটিতে নামার জন্য একখানা সরু কাঠের তক্তা স্থাপন করা হলো। যাত্রীরা ভীরু পায় টলতে টলতে নামলো। কিন্তু সেই জোয়ান কাঁধে দুই মন বোঝা নিয়ে বীরদর্পে নেমে পড়ল।
কপোতাক্ষ নদের এই খেয়াঘাটে মাত্র দুই খানা খেয়া নৌকা। একখানা মনু মিয়ার। অন্য খানা তার ভাই হারু মিয়ার। ঘাটের পশ্চিম পাড়ে পাটকেলঘাটার পুরাতন ডাক বাংলো। আর পূর্ব পাড়ে কুমিরার পুরাতন বাস স্ট্যান্ড। এই ঘাটের পুরানো মাঝি মনু মিয়া। চল্লিশ বছর ধরে এই ঘাটে পাটনির কাজ করে। লোহা কাঠের তৈরি নৌকা খানা তার বাবার হাতের। তার বাবার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে এই ঘাটের হাল ধরেছে মনু মিয়া। এই পথে পারাপারকারী সকল মানুষ তার চেনা। চল্লিশ বছর আগে কোন মানুষটা এই ঘাট পার হয়েছিল তাও বলে দিতে পারে সে। কে কয়বার এলো আর কে কয়বার গেল নদীর পানির মতো তরতর করে বলে দিতে পারে এই নিরক্ষর মাঝি। মনু মিয়া ও হারু মিয়া সারাদিনের ঘাট পারাপার করেন বটে কিন্তু কোন নগদ পয়সা কড়ি গ্রহণ করেনা। নগদ কড়ি গ্রহণ বা আদান-প্রদানের প্রচলন নেই এই ঘাটে। শুধু বছরে দুই বার বোরো ও আমন মৌসুমে এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান তোলে মনু মিয়া ও হারু মিয়া। নদীর দুই প্রান্তের যেসব গ্রামের মানুষেরা এই খেয়া পারাপার হয় তারা বছরে দুই ধামা করে ধান দেয়। গ্রামের বাড়ি বাড়ি হতে ধান সংগ্রহ করে সারা বছর খোরাকির সংস্থান করে তারা। এভাবেই কাটছে মনু ও হারু মাঝির জীবন।
সূর্যের তেজ কমে এসেছে। বেলা পড়ে এসেছে। সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। ঘাট পারাপার হয়ে যারা দুই প্রান্তে গিয়েছিল তাদের অধিকাংশই ফিরে এসেছে। শুধু মুখ চেনা কয়েকজন এখনো ফেরেনি। ঘাট পার হয়ে যারা এপার ওপার গেছে তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে মাঝিদের। এটাই এই ঘাটের নিয়ম। যারা এখনো ফেরেনি তাদের একজন গফুর।
সূর্য একেবারে কাত হয়ে পড়েছে। একদম গোল হয়ে গেছে। নদীর পশ্চিমের বাঁকটায় শান্ত জলে অর্ধেক ডুবে গেছে। বাকি অর্ধেক ঢেউয়ের দোলায় ভিজে যাচ্ছে। নদী তীর সন্ধ্যাঁর আবছা আঁধারে ছেঁয়ে গেছে। এমন সময় দূরে কার যেন ধারালো কন্ঠ শোনা গেল- “মনু মিয়া আমি আইসা পড়ছি। পরপর কণ্ঠে বেশ জোর পেল- “আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল।” বলতে বলতে নদীর কিনারে এসে পৌঁছালো আগন্তুক। কাঁধে তার দুই ঝুড়ি আখের গুড় পাটালি। তুই আইছো গফুর। তোর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম নৌকার খোল হতে পানি তুলতে তুলতে বলল মনু মিয়া। আজ বড় দেরি হয়ে গেল শান্ত গলায় বলল-গফুর।
আজ সকালের খেয়ায় মনু মিয়ার নৌকায় লুঙ্গি গেঞ্জি পরিহিত সুঠাম স্বাস্থ্যের দীর্ঘকায় ঘর্মাক্ত যে তাগড়া জোয়ানকে কাঁধে মালসহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল সে আর কেউ নয় সে হলো সন্ধ্যাঁর আগন্তুক গফুর।
গফুর এই খেয়ার নিয়মিত যাত্রী। রোজ শনিবার ও মঙ্গলবার সপ্তাহে দুই দিন এই ঘাট পার হয় সে। কাঁচা তরি-তরকারি ও গুড় পাটালির ব্যবসা তার। পনের মাইল পথ পায়ে হেঁটে কাঁধে বাক বহন করে কুমিরার বাজারে আসে গফুর। উত্তরে আখের চাষ ভালো হয়। তাই সে এদিক থেকে গুড়-পাটালি কিনে নিয়ে যায় দক্ষিনে। আজও দুই ঝুঁড়ি পাটালি কিনেছে সে। কাল সকালে যাবে পারুলির হাটে।
ছপছপ শব্দে দাঁড় বায় মনু মিয়া। জল কেটে তরি খানি তীরে ভিড়লো। এরই ফাঁকে জীবনের বাকি পড়া অনেক গল্প হলো গফুর আর মনু মাঝির। একখানা শক্ত পাটালি নৌকার কাঠের উপর ঘা মেরে ভেঙ্গে ফেলল গফুর। অর্ধেকটা পাটালি মনু মাঝির হাতে দিয়ে বলল- এই নাও মনু মিয়া, তোমার বাড়ির পোলাপান খাবার পারবে। হাত বাড়িয়ে পাটালি খানা নিতে নিতে মনু মিয়া বলল-তুই অনেক কষ্ট করিস গফুর। গফুর কষ্ট লুকিয়ে হেসে বললো-কষ্ট করি বলেই তো পেটে দু’বেলা ভাত জোটে। মনু মিয়ার নাও খানি দাঁড়িয়ে পড়ল। পাটালির বাক কাঁধে চাপিয়ে নেমে পড়ল সে। তারপর পশ্চিমের রাস্তা ধরে সন্ধ্যাঁর আবছা আঁধারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পঁচিশ বছর যাবত গুড় পাটালি আর কাঁচামালের কারবার করে গফুর। পনের বছর বয়সে তার বাবা মরার পর সংসারের হাল ধরেছে সে। এতে করে শুধু পেটের ভাতটুকু ছাড়া বিশেষ কিছু সঞ্জয় করতে পারেনি সে । বলা হয় গফুর বাক টেনে যত ঘাম ঝরিয়েছে সেই ঘামে মনু মাঝি তার নৌকা ভাসাতে পারবে অনায়াসে।
এখন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে গফুরের। কিন্তু তাকে তিরিশ বছরের তাগড়া জোয়ান বললে ভুল হবেনা। প্রচন্ড পরিশ্রমী সে। ঘামে ভেজা কালো চামড়ায় সব সময় পরিশ্রমের চিহ্ন ফুটে থাকে। মাথা ভর্তি অবিন্যস্ত কোঁকড়া কালো চুল। কাঁধে বাঁখারি সমেত মালসহ হাঁটার গতি ক্যাঙ্গারুর মত। বাঁখারির দুলনিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে সে। তাকে কখনো বিশ্রাম নিতে দেখা যায়না। ভাত খাওয়ার সময় পাচার উপর আসন গেড়ে বসেনা। দু’পায়ের পাতার উপর ভর করে ভারী আর গোলাকার নিতম্ব খানি ঝুলিয়ে বসে। কাঠের পিঁড়ি এগিয়ে দেয় গফুরের বউ ওফু্রন। কিন্তু পিঁড়িতে বসে খাওয়ার মত সময় যে তার হাতে নেই। গফুর দুই ছেলের বাপ। মাটির দেওয়ালের উপর গোল পাতার ছাওয়া একখানা ঘর। গোয়ালে হালের গরু নেই। একটি দুধের গাই আর দুই এক গন্ডা ছাগল ভেড়া নিয়ে গফুরের আর ওফুরনের সংসার।
আজ রবিবার। পারুলির হাট। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে লংকা মরিচ আর আখের পাটালি দিয়ে একথালা পান্তা সাবাড় করল গফুর। তারপর বাঁখারি সমেত পাটালির ঝুঁড়ি কাঁধে চাপিয়ে মরিচ্চাপ নদীর বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে ক্যাঙ্গারুর মত দুলে দুলে দ্রুত পাঁ চালালো। পায়ে হাঁটার পথ। পাঁচ ক্রোশ দুর পারুলির হাট। দ্রুত না পৌঁছলে হাট বেলা পার হয়ে যাবে। পারুলির হাট হতে দু’টো মাটির মালশা আর ভাতের হাড়ির শোরা আনার তাগাদা আছে গফুরের বউয়ের। আজ পাটালির ভালো দাম পাওয়া যাবে। ভালো আখের মিষ্টি পাঠালিটাই দিয়েছিল কুমিরার গনি বেপারী। ভাবতে ভাবতে কলকাতা খালের একদম কিনারে এসে পৌঁছে গেল গফুর। মরিচ্চাপ নদী হতে বেরিয়ে কলকাতা খাল পারুলিয়ার হাট ছুঁয়ে সীমান্তের ইছামতি নদীতে গিয়ে পড়েছে।
খাল পারাপারে একখানি বাঁশের সাঁকো। বেশ নড়বড়ে। তবুও পারাপারে দক্ষ মানুষেরা পার হয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। এই সাঁকো পার হওয়া গফুরের আজ নতুন না। জীবনে কতবার যে এই সাঁকো পার হয়েছে তার হিসেব নিজেও জানেনা। শুধু মানুষ নয় সাঁকোর দু’খানি বাঁশের উপর দিয়ে পেশাদার দক্ষ ছাগলও পার হয়ে যায়। ওপারে এক বৃদ্ধকে ঘাসের বোঝা মাথায় আসতে দেখা গেল। বৃদ্ধ নামলেই পার হবে গফুর। গফুর সাঁকোর উপরে উঠে পড়ে। খুব ধীরগতিতে সাবধানে পা ফেলে। তার হাঁটার গতি এখন আর ক্যাঙ্গারুর মত নয়। কচ্ছপের মত ধীর পায়ে সন্তর্পণে চলছে সাঁকোর উপর। ঝুলন্ত দুই ঝুঁড়ি পাটালির ভারে আজ সাঁকোটা যেন একটু বেশিই দুলছে।
কাঁধে দুই ঝুঁড়িতে মন দেড়েক পাটালি। সাঁকোর মাঝ বরাবর পৌঁছে গেল গফুর। সাঁকোটা একবার নড়ে উঠলো। তার শরীরও কিছুটা কেঁপে উঠল। কিন্তু টললোনা সে। সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে চলল। ওপারে কাস্তে হাতে কয়েকজন কৃষক দাঁড়িয়ে পারাপারের অপেক্ষা করছে। গফুরের এই সাঁকো পারাপারের দৃশ্য তাদের সাথে প্রকৃতিও যেন অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে। আর একবার দুলে উঠলো সাঁকোটা। তার সাথে গফুরের মনও কেঁপে উঠল। সাঁকো আর স্থির থাকলনা। ভার সইতে না পেরে দড়ির বাঁধন কেটে পড়ে গেল নিচে। পাটালির ঝুঁড়িসহ খালের জলে পড়ে গেল সে। জলের তলে তলিয়ে গেল পাটালির ঝুঁড়ি। সাঁতরে পাড়ে উঠে পড়ল গফুর। খালের লবণাক্ত পানি আর মিষ্টি পাটালির সংমিশ্রণে যে সুস্বাদু শরবত তৈরি হলো দুপুরের তা আগেই ভাটির টানে পৌঁছে যাবে ইছামাতির বিশাল জলরাশিতে।
গত এক মাস যাবৎ জ্বরে ভুগছে মনু মিয়া। একমাস পর আজ বেশ দুর্বল শরীর নিয়ে ঘাটে এসেছে। গত রাতের ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে সব কিছু ভেসে গেছে। নিজের পরিচিত ঠিকানার সবকিছু আজ অপরিচিত মনে হচ্ছে তার। ঘাটে বাঁধা নিজের নৌকাটিও চিনতে কষ্ট হচ্ছে মনু মিয়ার। জোয়ারের চাপে পলি জমে ভরে গেছে নৌকার খোল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও নাড়াতে পারল না সে। দশ বছর পর কেন জানি আজ গফুরের কথা মনে পড়লো তার। প্রায় এক যুগ হল গফুর আর এই পথে আসেনা। বেঁচে আছে কি মরে গেছে জানেনা। অনেক কষ্টে নৌকা পরিষ্কার করে জলে ভাসালো মনু মিয়া।
আজ নদীতে খুব জোয়ারের চাপ। নদীর ঘোলা জল পাক খেয়ে খেয়ে কলকল ছলছল শব্দ করে ছুটে চলছে উজানে। দু’পাড়ের পলিচরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কপোতাক্ষীর জল সাধারণত কবুতরের চোখের মতো টলটলে পরিষ্কার। কিন্তু গতকাল রাতে উপকূলে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত জলের উজান স্রোতে ঘোলাটে হয়ে গেছে নদীর পানি।
আজ আর দাঁড় বাইতে ইচ্ছে করছেনা মনু মিয়ার। বেলা বাড়ার আগেই বাড়ি ফিরবে সে। পানির স্রোতে বড় বড় ঘোল তৈরি হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ঘোলা জলের উচ্ছলতায় শুশুক কিংবা হাঙ্গর ওঠানামা করছে। নিজের নৌকা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মনু মিয়া। এমনই ঘোলাটে জল স্রোতে নৌকার তলদেশে কি যেন আটকে গেল। বৈঠা দিয়ে কয়েকবার অনুমান করার চেষ্টা করল সে। আকার আকৃতি মানুষের মতোই অনুভূত হলো। অনুমান একেবারে বেঠিক নয়। স্রোতের বেগে ভেসে আসা কোন মানুষের দেহ আটকে গেছে মনু মিয়ার নৌকায়।
মনু মাঝি তার ভাই হারু মাঝিকে ডাকল। দু’জনে টানাটানি করে তুলে ফেলল পাটাতনে। বেঁচে আছে কি মরে গেছে বোঝার জোঁ নেই। সারা গায়ে পলি কাঁদা জমে আছে। মাথার চুলগুলো খাটো নয়। আবার লম্বাও নয়। মাঝামাঝি কিন্তু কোঁকড়ানো। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে বলে অনুমান হলো। মুখ ভর্তি এলোমেলো দাড়ি চরের দুবলা ঘাসের মত। গায়ে পানি ঢেলে পরিষ্কার করা হলো। তারপর বুকে কান পাতলো মনু মিয়া। মনু মিয়ার চোখে আলোর ঝলকানি খেলে গেল। আরো গভীর ভাবে কান পাতলা সে, বুকের ভিতর ধুক ধুকানি শুনতে পেল বোধহয়। আরও নিশ্চিত হতে তার ভাই হারুকে বলল-
“তুই একটু দেখ দিন হারু।”
হারু মিয়া বলল- “মনে হচ্ছে বেঁচে আছে।” চোখ দু’টো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল মনু ও হারু মিয়ার।
মুমূর্ষ লোকটির প্রতি আরো দরদ ও ভালোবাসা বেড়ে গেল মনু মাঝির। লোকটার গায়ে একটি হাফ হাতা সাদা সুতি গেঞ্জি। ছেঁড়া আর কাঁদার ছোপে অপরিপাটি। লোকটাকে একেবারে অপরিচিত মনে হলো না হারু মিয়ার। আবার গেঞ্জিটা বেশ চেনা লাগলো। এ ধরনের হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি কাকে যেন অনেকবার পড়তে দেখেছে কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেনা মনু মিয়া।
ঘাটের কাছাকাছি অচিনতলা গ্রামে বাড়ি মনু মাঝির। লোকটাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিল তারা। অনেক সেবা যত্ন আর গরম পানির স্পর্শে ধীরে ধীরে চোখ খুলল লোকটা। কিন্তু এখনো তার কন্ঠ আড়ষ্ট কথা বলতে পারল না সে।
পরদিন সকালে তুলে বসানো হলো লোকটাকে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। মনু মাঝি খুব কাছাকাছি এসে বলল-
“কেমন আছো গো এখন কেমন ঠেকছে শরীর।”
কোন কথা বললনা লোকটা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো মনু মিয়ার চোখে। এলোমেলো উস্কো-খুস্কো দাড়ির আড়ালে লুকানো মুখ খুব চেনা চেনা মনে হল তার। মনু মিয়াও গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল লোকটির চোখে। মনু মাঝি লোকটাকে চিনতে না পারলেও লোকটার ভাষাহীন চোখ বলছে মনু মাঝিকে সে খুব চেনে। লোকটার আড়ষ্ট জিহ্বায় ভাষা না থাকায় তার অসহায় চোখের ফ্যালফ্যালানি আরো বেড়ে গেল।
দু’এক দিনের শুশ্রুষা ও পরিচর্যায় সুস্থ আর খড়খড়ে হয়ে উঠল লোকটা। তাকে আশ্রয়ে এনে মনু নিয়ার গলায় যেন মাছের কাঁটা বিঁধে আছে। পড়ন্ত বিকেলে আরেকবার লোকটাকে দেখতে এলো মনু মিয়া। দরদের সুরে জানতে চাইলো- “তোমার নাম কি বাপু।”
লোকটার ঠোঁট নড়ে উঠলো একবার। কন্ঠ আড়স্ট হয়ে আছে।
অস্ফুট স্বরে শুধু এতটুকু বলল- গ ফ র। গফর শব্দটা যেন খুব পরিচিত মনে হল মনু মিয়ার কাছে। কিন্তু সঠিক চিনতে না পেরে আবার জানতে চাইলো-
“নাম কহ বাপু, বাড়ি কহ কোথাকার লোক তুমি।”
আমার নাম গফুর। বাড়ি এল্লার চরে। এবার আর চিনতে বাকি রইল না মনু মিয়ার। উচ্চ কণ্ঠে উচ্চসিত গলায় বলল- “গফুর-গফুর না, এযে আমাদের গফুর। গফুর বাঁখারি। মনু মিয়া তার বউকে ডেকে বলল- “বছর দশেক আগে একদিন রাতে অর্ধেক ভাঙ্গা পাটালি যে দেছিল এই সেই গফুর। গফুরের প্রতি দরদ আর ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গেল মনু মিয়ার।
গত কয়েক দিনের ঝড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে উপকূলের ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপড়ে পড়েছে গাছপালা। উড়ে গেছে এল্লার চরের বসতি। ঝড়ের রাতের সেই কাহিনী আস্তে আস্তে শোনা গেল গফুরের মুখে….।
গত মঙ্গলবার মধ্যরাত আকাশে মেঘ ছিলনা। সহসা বাতাসের শাশা শাশা শব্দ শোনা গেল। ঝড় উঠলো। প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে মর্মর শব্দে গাছপালা ভেঙে পড়ল। ঘরবাড়ির চাল উড়ে গেল পলকে। গরু-বাছুর দৌড়ে পালালো দিগ্বিদিক। ঝড়ের পরপর এলো জলোচ্ছ্বাস। ভাসিয়ে নিল উপকূলের সবকিছু। গ্রামের পর গ্রামের বসতি ভেসে গেল। ছেলে দু’টোকে ধরে রেখেছিলাম আমার বুকের সাথে। কিন্তু সর্বনাশা ঝড় কেড়ে নিয়ে গেল আমার বুকের মানিক। খোকার মায়ের কথা বলতে পারিনে। হয়তো ভেসে কাছে বানের জলে। আমি জল বাতাসের সাথে লড়াই করে টিকে ছিলাম বহুক্ষণ। শেষ রাতে সাগর ফুলে উঠলো আরেকবার। আরেক দফা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেলাম জলের স্রোতে। অন্ধঁকারে কোথায় হারিয়ে গেলাম এখন তার আর কিছু মনে নেই। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি জানিনা। গফুরের কথাগুলো শুনে কেঁদে ফেলল উপস্থিত লোকজন।
তার পর দিন মনু মিয়ার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল গফুর। এল্লারচরে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যে চরে বসতি ছিল হাজার হাজার মানুষের। সেই চর এখন বিরানভূমি। তার ঘর নেই বাড়ি নেই। ভিটেমাটির অস্তিত্ব নেই। কোথায় যাবে তাও জানেনা সে। চেনা পথ গুলো আজ বড় অচেনা পথের মতো মনে হল গফুরের। গফুর এখন নিঃসঙ্গ ঠিকানাহীন। শেষ বিকেল। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় হেলান দেওয়া আকাশের দিকে উর্ধ্বমুখী তাকিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে পশ্চিমে হাঁটছে গফুর।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর সাতঘরিয়া মহাকুমায় নতুন এসডিও সাহেব এসেছেন। এসডিও সাহেব ছিল করাচির লোক। পূর্ব পাকিস্তানের সাতঘরিয়া অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। এসডিও সাহেবের সাথে এসেছেন তার সুন্দরী স্ত্রী। দম্পতির পোশাক আশাক এদেশী নয়। এসডিও সাহেবের নাম আজমল শরীফ খান। দীর্ঘ দেহী সু-স্বাস্থের অধিকারী। পাকিস্তানি পোশাক আর ভদ্রতার ছাপে এদেশী বাঙালি থেকে সহজেই আলাদা করা যায় তাকে। বেশ ভদ্র আর মার্জিত শিক্ষিত গোছের।
এসডিও সাহেব গরুর গাড়ি যোগে এসে মালপত্রসহ উঠলো সরকারি বাংলোয়। সাহেবের বাসা তদারকি ও দেখভালের জন্য একজন কেয়ারটেকার প্রয়োজন। পরদিন এসডিও সাহেবের নায়েব মহাশয় অনেক খোঁজা খুঁজির পর একজন বয়স্ক লোককে সাথে করে আনলো এসডিও সাহেবের বাংলোয়। এসডিও সাহেব জিজ্ঞেস করলেন- “কিয়া ন্যাম বাত হে? নাম কি তোমার।”
উত্তর শোনা গেল- গফুর।
“গফুর ? নাকি আব্দুল গফুর?” বললেন সাহেব।
না সাহেব শুধুই- গফুর।
সাহেব হেসে বললেন- সামজে-সামজে। বুঝেছি বুঝেছি।
গফুর এসডিও সাহেবের বাংলোয় থাকেন। গাছ গাছালির পরিচর্যা করেন। সংসারের বাজার হতে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনে গফুর এখন অনিবার্য অবলম্বন হয়ে উঠল এই পরিবারের।
ইতিমধ্যে বছর পাঁচেক পেরিয়ে গেল। দম্পতির ঘরে জন্ম নিল দুইটা জমজ পুত্র সন্তান। ফুটফুটে সুন্দর লাজুক আর মায়াময় দৃষ্টি। গফুর তাদের সর্বদা আগলে রাখেন। এক ছুটির দিনের বিকালে সাহেব বাগানে একটি মোড়া পেতে বসলেন। পাশে তার সুন্দরী স্ত্রী গুলবাহার বসে আছেন। বাচ্চা দু’টো আনন্দে ছোটাছুটি করছে ফুলবাগানে। কখনো প্রজাপতি ধরার চেষ্টায় ফুলে ফুলে ছুটছে। গফুর কিছুটা চা নাস্তা দিয়ে পাশে দাঁড়ালো। সাহেব আজ গফুরের জীবনের গল্প গুলো সব শুনলেন। তার স্ত্রী পুত্রের বিয়োগ ব্যথায় ব্যথিত অনুতপ্ত হলেন। তোমার স্ত্রীকে খুঁজে পাওনি কোথাও? –এসডিও সাহেবের স্ত্রী উর্দু বাংলা মিশিয়ে জানতে চাইলেন। গফুর শুধু মাথা নাড়লো মুখে কিছু বললো না।
গফুর এখন এই পরিবারের একজন সক্রিয় সদস্য। সে তার সবটুকু উজাড় করে বাচ্চা দু’টোকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করে। গফুরের মধ্যে পুত্র স্নেহ এতটাই প্রবল হলো যে, বাচ্চা দু’টোকে তার দুই কাঁধে চড়িয়ে সে তাদেরকে আনন্দ দানের পাশাপাশি নিজেও আনন্দ লাভ করত।
ভাদ্র মাস। গুড়পুকুরের মেলা শুরু হয়েছে। গফুর বাচ্চা দুটোকে দু’কাঁধে চড়িয়ে মেলা দেখাতে নিয়ে গেল। মাটির ঘোড়া, কাঠের লাটিম আর রঙিন পুতুল কিনে দিল। তারপর ফেরার সময় দেছের মিয়ার সাথে দেখা হল গফুরের। দেছের মিয়া বড় ব্যবসায়ী লোক। গফুরের তার সমবয়সী। কাপড়ের ব্যবসা আছে তার। সায়েরের বাজারের সবচেয়ে পুরানো আর বড় টিনের দোকান খানা দেছের মিয়ার। দেছের মিয়া বললো-
“কিরে গফুর তোর ঘাড়ের ওপর বাচ্চা দুটো কারা?”
গফুর বলল- এসডিও সাহেবের ছেলে। শুনে বেশ চমকে গেল দেছের মিয়া। দেছের মিয়া বড় মনের মানুষ। সে নিজের দোকান হতে দুইটা ঝলমলে রঙিন পোশাক পরিয়ে দিল বাচ্চাদের। গফুর ফিরে গেল বাংলোয়। বাচ্চাদের এমন দামী আর ঝলমলে পোশাকে দেখে এসডিও সাহেব ও তার স্ত্রী অভিভূত হলো। নিজের সন্তানের প্রতি গফুরের এমন স্নেহ ও ভালোবাসা দেখে গফুরের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল।
এদেশ গরিব দেশ। এদেশের মানুষ দরিদ্র। এদেশের মানুষের পোশাক নেই বললেই চলে। এখনো তেমন কোন কাপড়ের কল গড়ে ওঠেনি এদেশে। এসডিও সাহেব তার স্ত্রীকে বলছিলেন কথা গুলো। এসডিও সাহেবের প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ড হতে পঁচিশ লট তৈরি পোশাক আনা হয়েছে। পোশাকের লট গুলো কাল প্রকাশ্য নিলামের ডাক হবে। সাহেব তার স্ত্রীকে বলে গেলেন- “গফুর যেন প্রকাশ্য নিলাম ডাকের সময় সেখানে উপস্থিত থাকে।” অন্যদের হাকা দামের চেয়ে সব সময় যেন বেশি দাম বলে। থানা সদর লোকে লোকারণ্য। শহুরে এলাকার ধনাট্য ব্যবসায়ীরা সব উপস্থিত হয়েছে। দেছের মিয়াও আছেন। ভিড়ের মধ্যে গফুরকে দেখা গেল দরজার এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে।
পঁচিশটা কাপড়ের লট। প্রতি লট পাঁচ হাজার টাকা করে ডাক উঠল। পঁচিশ লট মোট এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা দাম উঠলো। এবার ভিড়ের মধ্যে থেকে গফুরের গলার আওয়াজ শোনা গেল। গফুর বলল- এক লক্ষ সাতাশ হাজার টাকা। এক লক্ষ সাতাশ হাজার এক। এক লক্ষ সাতাশ হাজার দুই-বলেই সিল মেরে দেওয়া হলো লটের উপর।
নিলাম সভা ভেঙ্গে গেল। সকলে প্রস্থান করলেন। এসডিও সাহেব নিলামের সমুদয় টাকা গফুরের পক্ষ হতে পরিশোধ করে দিলেন। সেদিনের এক লক্ষ সাতাশ হাজার টাকা এখনকার দিনে কয়েক কোটি টাকার সমান। এই ঘটনার কয়েক মাস পর এসডিও সাহেব ও তার স্ত্রী এদেশ ছেড়ে চলে গেলেন করাচিতে। গফুরের মনটা ব্যথায় কেঁদে উঠলো। সে তার স্ত্রী পুত্রের বিয়োগ ব্যথায় কখনো এমন মুষড়ে পড়েনি।
সেদিনের পর গফুরও বাংলো ছেড়ে চলে এলো। কাপড়ের ব্যবসা শুরু করল। চাহিদা ব্যাপক কিন্তু মানুষের হাতে টাকা পয়সা কম। পঁচিশটা লটের কাপড় লট প্রতি পাঁচ হাজার পড়েছে। কিন্তু বিক্রি হলো প্রতিটা আট হাজার দশ হাজার করে। গফুর বুদ্ধিমান লোক সে টাকা গচ্ছিত না রেখে এক দাগেই এক’শ বিঘা জমি কিনে ফেলল। সায়েরের বাজারের দক্ষিণ দিকে প্রাণসায়ের খালের পূর্ব পাড়ে একখানা দেউড়ি নির্মাণ করল। জমিদারী আদলে তৈরি করল প্রাসাদ বাড়ি। গফুর আবার তার ভাঙ্গা জীবন থেকে ফের কোমর সোজা করে দাঁড়ালো।
গফুর সৎ মানুষ। বিচক্ষণ আর দানশীল। মানুষের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ঘরবাড়ি তৈরির সাথে সাথে গফুর নিজেকেও বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে নিল। লুঙ্গি আর গেঞ্জি ছেড়ে পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি চড়ালো। অবিন্যস্ত এলোমেলো কোঁকড়া চুলে চিরুনি আঁচড় পড়ে সুবিন্যস্ত হলো। পায়ে চাপালো বিলেত হতে আনা চামড়ার জুতা। কালো ফ্রেমের একখানা মোটা চশমাও কিনলেন। হাতে বয়সের সাথে মানানসই একটি লাঠিও ব্যবহার করেন গফুর। তবে তার লাঠি ভারসাম্য রক্ষার জন্য নয় বরং নিজের ক্ষমতাও আভিজাত্য আর সম্মানের প্রতীক হিসেবে। তখনকার দিনে বনেদি ঘরের লোকেদের এমন লাঠি ব্যবহারের রীতি ছিল।
লোকে বলে গফুর এখন আর গফুর নেই। এখন লোকে তাকে গফুর সাহেব বলে ডাকে। একদা গফুরের যে কাঁধে থাকতো মালবাহী বাঁশের বাখারি সেই কাঁধে আজ ঝুলানো দেখা গেল একখানা কাশ্মিরী শাল।
গফুর সাহেব সেদিন তার দেউড়ি ঘরে বসে ছিলেন লোকজন নিয়ে। আরো এক’শ বিঘা জমির বায়না পত্র করতে দেন-দরবার করছেন কয়েকজন লোকের সাথে। এতদিনে গফুর সাহেব এলাকার একজন নামী দামী মানুষে পরিণত হয়েছে। সাধ্যমত মানুষের বিপদে সাহায্য করেন। কারো ঘরের চালের ছন কিনে দেন। কারো মাটির দেয়ালের ওপর তুলে দেন টালির চাল। প্রতিদিন কেউ না কেউ তার দান-দাক্ষিণ্য গ্রহণে আসে তার দেউড়িতে।
সেদিন সকালে একজন বিধবা মহিলাকে দেখা গেল গফুর সাহেবের দেউড়ির দিকে আসতে। গফুর সাহেবের বদান্যতার কথা শুনে এসেছে একটু সাহায্যের আশায়। পরনে জীর্ণ-শীর্ণ মলিন বিধবার বেশ। পায়ে জুতা নেই। একখানা এক রঙ্গা শাড়ি কোমরে পেচিয়ে বুকের উপর দিয়ে আঁচলের এক প্যেঁচ কোন রকম তুলেছে মাথার উপর। শাড়ির নিচে পরবার মত অতিরিক্ত শায়া-ব্লাউজ জোগাড়ের সামর্থ্য যে তার নেই তার উদোম শরীর দেখে যে কেউ বুঝবে। আঁচলের এক প্রান্ত এক চোখের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নাক বরাবর এনে দাঁতে কামড়ে রেখেছে মহিলা। আগন্তুক মহিলার চলন-বলন আর মতিগতি বুঝিয়ে দিল বিধবা কোন দায় নিয়েই এসেছে গফুরের দরজায়।
মহিলা কিছু বলার আগেই তার পরিচয় জানতে চাইলেন গফুর সাহেব। ঘর নেই বাড়ি নেই দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই, জানালো বিধবা।
স্বামী সন্তান কেউ কি নেই, পুনরায় জানতে চাইলো কৌতুহলী গফুর।
সবই ছিল বেঁচে আছে কি মরে গেছে জানিনা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল বিধবা।
কি নাম তোমার স্বামীর জানতে চাইলেন গফুর সাহেব।
সাহেবের নামে নাম ছিল তার- বলল মহিলা।
চোখ কপালে তুললেন গফুর সাহেব। ধীরে ধীরে বসা থেকে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল মহিলার দিকে। ঘোমটার আড়ালে লুকানো তার মুখখানা খুব চেনা চেনা মনে হল গফুরের। মহিলার মুখ খানা খুব কাছ থেকে গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করছে গফুর। তার স্ত্রী ওফু্রনের মতই দেখতে। মহিলার হাতে দুই খানা পিতলের চুড়ি দেখে আর চিনতে বাকি রইলনা যে আগন্তুক মহিলা তারই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী ওফুরন।
তুমি, তুমি ওফুরন না? আবেগ তাড়িত হয়ে বললেন গফুর সাহেব।
কিন্তু সাহেব আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন? একরাশ কৌতূহল উদ্দীপনা আর দু’চোখ ভরা বিষ্ময় নিয়ে গফুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল মহিলা।
আমি গফুর তোমার মফিজ-তছিমের বাপ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল মহিলার। সে জানে তার স্বামী গফুর অনেক বছর আগে মারা গেছে। আর বেঁচে থাকলেও তার সামনে উপস্থিত এই ধনাট্য লোকটি যে তার স্বামী গফুর, একটি পাহাড়কে নিজের মাথার উপর তুলে ধরার মতো অবিশ্বাস আর অবাস্তব মনে হল তার। তাকে অভয় দিল গফুর।
স্ত্রী ওফুরনকে ফিরে পেয়ে সুখের দিনে আজ বেদনার সিন্ধু আরো যেন গভীর হলো তার। ওফুরনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল গফুর। নিজের ছেলে দু্’টোর কথা বিস্মৃত মনের শূণ্য মাঠে নতুন করে মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। ওফুরন কে সাথে নিয়ে দেউড়ি ছেড়ে প্রাসাদ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন গফুর সাহেব।
সেদিন রাতে একখানা মাদুর পেতে খেতে বসেছেন গফুর সাহেব। ওফুরুন যেন আজ প্রাণপতি দেবতাকে কাছে পেয়ে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার নির্যাসে বিচিত্র পদের ব্যঞ্জন অর্ঘ্য নিবেদন করছেন তার পতি দেবতার অন্ন থালায়। গফুর সাহেব যেন বিশ বছর পূর্বের আপন পত্নীর হাতের রন্ধনকৃত ব্যঞ্জন আঙ্গুল ছেঁটে তৃপ্তির আস্বাদ লাভ করছেন। অর্ধপানাহার শেষে ওফুরন কেঁদে উঠলো। এই কান্নার কোন কারণ জানা নেই গফুরের। গফুর ভাবলো ঝড়ের রাতে তাদের নিখোঁজ হওয়া আর সন্তানের বিচ্ছেদ বেদনার কথা স্মরণে আসায় আবেগ রুধিতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে ওফুরন। ওফুরনের ক্রন্দনরত ভেজা চোখের দিকে তাকালো একবার সে। কিন্তু আশ্চর্য জনকভাবে গফুরের সকল ভাবনা মিথ্যা প্রমাণ করে ঝড়ের রাতের আরো দশ বছর আগের স্মৃতি চারণ করে ব্যথিত হৃদয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে ওফুরন বলল-
“যেদিন তুমি পাটালির বোঝা নিয়ে খালের সাঁকো ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিলে সেদিন আমাদের ঘরে কোন চাল ছিলনা তুমি শুন্য হাতে বাড়ি ফিরে দাওয়াই বসলে, সেদিন আমি তোমার ক্ষুধার্ত মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারিনি।” বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলো ওফুরন।
রাত্রিবেলা শুয়ে অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করছিল গফুর ও ওফুরন। মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের ঘুম এলোনা। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত দু’টো হারানো প্রাণ অভাবের দিনে একে অপরের সাথী ছিল একদিন। সেই ঝড়ের রাতের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল আরেকবার। তারপর দু’জনের বাকি রাত আর ঘুম হলোনা। দশ বছর আগের সেই প্রাণ-বিধ্বংসী বিচ্ছেদকারী প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের রাতের স্মৃতিচারণ করতে করতে ভোরের সূর্যোদয় হল।
ইতিমধ্যে গফুর সাহেবের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তার দেউড়িতে সকাল বিকাল থাকে মানুষের ভিড়। একেক জন একেক প্রয়োজনে আসে তার কাছে। কেউ টাকা ধার নিতে আসে কেউ জমি বর্গা নিতে আসে। একদা যে গফুরের কোন জমি ছিল না আজ সে দু’শ বিঘা জমির মালিক। যে গফুর লোকের খেতে কামলা খেটেই যেত আজ তার ক্ষেতে কামলা দেয় শত শত চাষী। গফুর সাহেব স্বশিক্ষিত মানুষ। ব্যবসায়ী কারবার করতে করতে রপ্ত করে ফেলেছে হিসাবের কায়দা কৌশল। মোটা অক্ষরগুলো এখন তার আয়ত্তে চলে এসেছে। লেখার কলমটাও ধরতে শিখেছেন সময়ের প্রয়োজনে। গফুর সাহেব গ্রামের লোক। তাই তার ব্যবসা গুলোও হল কৃষি ভিত্তিক। পাটের গুদাম গুড়ের ব্যবসা তার ব্যবসার প্রধান মাধ্যম।
পরের দিন সকাল। সামনের দেউড়িতে একটি বেতের মোড়া পেতে বসে আছেন গফুর সাহেব। রাতে ওফুরনের সাথে স্মৃতিচারণ করা মুহূর্তগুলো রোমন্থন করলো আর একবার। গফুর সাহেবের চারপাশে এখন হাজার লোকের ভিড় জমে থাকে সব সময় । মুখ চেনা পরিচিত লোক গুলোর আড়ালে গফুরের স্মৃতির আয়নায় বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে একটি মুখ। এই মুখ এক বৃদ্ধ পাটনীর। গফুরের জীবনের পঁচিশ বছরের উত্থান পতনের জলন্ত সাক্ষী। এই বৃদ্ধ মাঝি আর কেউ নয় কপোতাক্ষ নদের ডাকবাংলো ঘাটের মাঝি মনু মিয়া। মনু মিয়ার কথা মনে পড়তেই গফুর স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ল। গফুর আর স্থির থাকতে পারলনা। মনু মিয়ার সাথে দেখা করতে তার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
পরের শনিবার। কুমিরা বাজারে হাটের দিন। গফুর সাহেবের দেউড়ির সামনে একখানা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়ানো। গফুর সাহেব কোন জমিদার নয়। কিন্তু তার সাজগোজ আর ঘোড়ার বাহন জমিদারের চেয়েও কোন অংশে কম নয়। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর সুঠাম স্বাস্থ্যের ভরাট মুখের ঠোঁটের উপর চওড়া গোঁফে তাকে বেশ মানিয়ে যায়। একদিন যে গফুর পাতার তামাক ভরা বিড়িতে টান মেরে শরীরের ঘাম নিবারণ করত সেই গফুর সাহেবের মুখে এখন জমিদারি আদলের হুক্কা পাইপ। চামড়ার পাদুকা পায়ে হাতের ছড়ি খানা ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসলেন। গফুর সাহেব যেদিন থেকে সাহেব হয়েছেন তখন থেকে সব সময় সাথে একখানা বেতের ছড়ি ব্যবহার করেন। এই বেতের লাঠি খানা অবশ্য তিনি ভারসাম্য রক্ষার জন্য ব্যবহার করেননা বরং এটা তার ক্ষমতা আভিজাত্য ও সম্মানের প্রতীক।
গফুর সাহেব এখন ধনাঢ্য পুঁজিপতি বটে কিন্তু তিনি সৎ ও বিনয়ী। অহংকারের চাদরে ঢাকা পড়েনি তার বিবেক। তিনি ছিলেন মানুষের দরদী বন্ধু গরিবের সুখ-দুঃখের সাথী। পকেটের টাকার গন্ধে তার চরিত্র বদলায়নি। গফুর বাঁখারি থেকে গফুর সাহেব হওয়ার পরেও তিনি আগের মতই বাঁখারি গফুর হয়েই আছেন মানুষের হৃদয়ে। আসলে গফুরের মার্জিত রুচি সম্পন্ন ভদ্র পোশাক আশাক বহিরাবরণ বদলেছে বটে কিন্তু তার চরিত্র ও মন মেজাজের সততা বন্ধু বৎসল সরল কোমলতা কখনো কাঠিন্যে পৌঁছায়নি।
কচোয়ান ইশারা করতেই ছুটে চললো ঘোড়ার গাড়ি। আজ গফুর সাহেবের সঙ্গী হয়েছেন স্বয়ং ওফুরন। সাথে আছেন আরো কয়েকজন ভক্ত অনুরাগী। দ্রুত পায়ে ঘোড়া এগিয়ে চলছে। গন্তব্য কপোতাক্ষ নদের ডাক বাংলো ঘাট।
বেলা পড়ে এসেছে। পথ ফুরিয়ে এসেছে। আর একটু এগুলোই ডাক বাংলোর ঘাট। আজ এই ঘোড়ার গাড়ি যাকে বহন করে চলেছে সেই যাত্রী একদিন কাঁধে বোঝা নিয়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে এই সমগ্রপথ। এই পথের ধুলার গন্ধ নাকে লাগে গফুরের। তার সহযাত্রীরা চোখের সামনে বিরজমান বাস্তব প্রকৃতি দেখলেও গফুরের চোখ দেখছে বিশ বছর আগের প্রকৃতির চিত্র। দেখতে দেখতে ঘাটের প্রান্তে এসে দাঁড়ালো গফুর সাহেবকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু গফুর সাহেব নামছেন না। তিনি যেন ভুল পথে পৌঁছেছেন। এইঘাট যেন সেই ঘাট নয়। এই ঘাট মনু মাঝির ঘাট নয়। জীবনে অসংখ্য বার যে ঘাট পারাপার হয়েছে আজ যেন পথ ভুলে ভিন্ন কোন ঘাটে এসে পৌঁছেছে গফুর সাহেব।
বিশ বছর আগের দেখা ঘাট খানি আজ কংক্রিটে ঢাকা পড়ে গেছে। বাঁশের মই লাগানো সিঁড়ির পরিবর্তে একটি সুদৃশ্য পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। গফুর সাহেব ধীরে ধীরে নামলেন। নদীর কিনারা বরাবর দাঁড়িয়ে বললেন-
“জানো ওফুরন তখনকার দিনে এখানে পারাপারের জন্য মনু মাঝি আর তার ভাই হারু মাঝির দু’খানা দাড় টানা নৌকা ছিল আজ সেখানে শত শত ইঞ্জিন চালিত কলের নৌকা।”
ঘাট ছেড়ে একের পর এক নৌকা চলে যাচ্ছে। আবার মাল বোঝায় নতুন নৌকা ঘাটে ভিড়ছে। গফুর ঘাটের দৃশ্য অবাক বিস্ময়ে দেখছে আর বিড়বিড় করে ভাবছে- “একটা সময় যেখানে লোকের অভাবে খেয়াই ছাড়ত না আজ সেখানে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় শত শত যাত্রী ধরে না।”
এই ঘাট এখন শুধু মাত্র যাত্রী পারাপারের জন্য নয়। দূরের যাত্রীও বহন করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এই ঘাট। লঞ্চ আর স্টিমারে কপিলমুনি হতে আসে মাটির তৈজপত্র। আসে গুড়ের কলসবাহী বড় বড় ট্রলার। দাঁড় টানা ডিঙে এখন আর চলে না। বড় বড় কলের নৌকা ঘোলা জলের স্রোতে ঘুরপাক খেতে খেতে পণ্যের পরসা নিয়ে চলে যাচ্ছে দূরের গঞ্জে।
ধনাঢ্য লোকেরা কলের নৌকা আমদানি করে ভাড়ায় দিয়েছে। কিছু লোক নিজের নৌকা নিজে চালায়। ঘাটের এক কোণে টিনের ঘর বেঁধে বসেছে ইজারাদার। ঘাটে নামার আগেই টাকা পরিশোধ করে তারপর নৌকায় উঠতে হয়। মনু মাঝির দিন আর নেই। বিনা পয়সায় ঘাট পারাপার মনু মিয়া ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ করবেনা। জীবনে বহুবার এই ঘাট পার হয়েছে গফুর সাহেব কিন্তু কখনো টাকা লাগেনি। নগদ কোনো কানা কড়ি মনু মিয়ার হাতে দিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। বছরান্তে দু’ধামা ধান ছিল মনু মিয়ার পারিশ্রমিক। আর আজ ঘাটে নামার আগেই দুই টাকা জমা দিয়েই তবে নৌকায় চড়ল গফুর সাহেব। নৌকায় উঠলেন বটে কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। এই ঘাটে কোন বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় পাবে মনু মিয়াকে।
তার জীবনের দেনা প্রাণ বাঁচানোর ঝণ আর বুঝি শোধ হবেনা। ভাবতে ভাবতে নদী পেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো কলের নৌকা। গফুর সাহেব ঘাটে নেমে পড়লেন। আগে ঘাটে নামতে একখানা সরু কাঠের তক্তা ব্যবহার হতো। গফুর সাহেবের চোখে আজ সবকিছুই যেন অন্যরকম ঠেকছে। ওপারের নদীর শুকনো চরে ঘাসের উপর উপুড় করে রাখা হয়েছে অনেক গুলো বড় বড় নৌকা। কোনটা মেরামত চলছে আবার কোনটা নতুন তৈরি করা হচ্ছে। আশিতিপির এক বৃদ্ধকে দেখা গেল একখানা বড়সড়ো নৌকার তলায় আগুনে গরম করে আলকাতরা লাগাচ্ছে। ধীর পায়ে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলেন গফুর সাহেব। ফর্সা শরীরের চামড়া বেশ ঢিল হয়ে গেছে। মুখে সাদা দাড়ি চরের উদোম বাতাসে দুলছে। পরনে একখানা লুঙ্গি কাছা পাকিয়ে কোমরে গোটানো। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ বলল-
বাবু কি বিদেশি বুঝি।
না, আমি এ দেশী।
তা জেনে তোমার কি কাজ শান্ত গলায় বললেন গফুর সাহেব।
এমনি জানতে চাইছিলাম। ক্ষমা করবেন বাবু।
না সাহেব ,না না বাবু।
আসলে সঠিক বুঝতে পারিনি আপনি বাবু না সাহেব।
ও আচ্ছা এবার বুঝেছি আপনি মুসলমান তার মানে আপনি সাহেব, কি ঠিক বলছি না সাহেব।
গফুর সাহেব মুচকি হাসলেন।
তার গড়গড়া টানা পাইপে একটা টান মেরে অত্যান্ত সহজ সরল ভঙ্গিতে হেসে জানতে চাইলেন-
আচ্ছা তুমি এই ঘাটে কত বছর কাজ কর?
তা সাহেব পঞ্চাশ বছর তো হবে উচ্ছ্বাসে বলে ফেলল বৃদ্ধ।
আচ্ছা বাপু তুমি কি মনু মিয়া হারু মিয়া নামে কাউকে চেনো?
ভুরু কুঞ্চিত করে জানতে চাইলেন গফুর সাহেব।
হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি তো সাহেব।
তো তার সাথে আপনার কি কাজ?
সহজ সরল ভাবে ব্যস্ততার সাথে প্রশ্ন করল বৃদ্ধ।
বয়স্ক বৃদ্ধ লোকেরাই শুধু বয়স্ক মানুষের খবর বলতে পারবে এই ভাবনা হতেই মনু মাঝির পরিচয় দিতে শুরু করলো গফুর-
“আমি একজন বৃদ্ধ মাঝিকে খুঁজছি যার নাম মনু মিয়া। পূর্ব দিকের অচিনতলা গ্রামের লোক। সে ছিল এই ঘাটের পুরাতন মাঝি। সে ও তার ভাই হারু মিয়ার দুইখানা ডিঙ্গি নৌকা ছাড়া আর কোন নৌকা ছিলনা এই ঘাটে। আমি সেই বৃদ্ধ মাঝি মনু মিয়ার খোঁজে এসেছি। তোমারি বয়সী হবে। তুমি কি বলতে পারবে এমন কোন মাঝির সন্ধান? অন্তত এখনো বেঁচে আছি নাকি মরে গেছে এতটুকু খবর!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করলেন গফুর সাহেব।
এই সাহেব যে বৃদ্ধ মাঝির অন্বেষণে এই নদী চরে এসেছেন সেই বৃদ্ধ যে স্বয়ং তার সামনে উপস্থিত সে কথা আর বুঝতে বাকি রইলোনা বৃদ্ধের। বৃদ্ধ লোকটি এবার উল্টানো নৌকার উপর হতে আলকাতরার মাটির হাড়িখানা রেখে মই বেয়ে নিচে নেমে এলো।
কাতর কন্ঠে বলল-
আপনি যার সন্ধানে এসেছেন সাহেব আমি সেই বৃদ্ধ মাঝি মনু মিয়া।
কিন্তু আপনি কে?
একথা বলতেই বৃদ্ধকে বুকে জড়িয়ে ধরল গফুর সাহেব। বলল আরে আমাকে চিনতে পারনি মনু মিয়া। আমি সেই গফুর। তোমার খেয়ার শেষ যাত্রী। গফুর নামটি শুনতেই মুষড়ে পড়লো মনু মিয়া। গফুরকে নিজের সন্তানের মত চেনে সে। নিজের বন্ধুর মত চেনে। কিন্তু এই সাহেবকে তার চেনা সেই গফুর বাঁখারী বলে একদম মনে হলোনা মনু মিয়ার।
তার সামনে দাঁড়ানো ভদ্র লোকের মাঝে তার চেনা গফুরের কোন চিহ্ন খুঁজে পেলনা মনু মিয়া। গফুর নাম স্মরণে আসতে তার চোখের পাতায় ভেসে উঠলো লুঙ্গি পরা হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি পরিহিত কাঁধে বাঁশের বাঁখারী বহনকারী শক্তিমান এক জোয়ানের চেহারা।
গফুর সাহেব এবার মনু মিয়ার নৌকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ পেশ করলেন একের পর এক। ঝড়ের রাতে ভেসে আসা গফুরকে মনু মিয়া যে নদী থেকে নৌকায় তুলে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাও বর্ণনা করলো সবিস্তারে। মনু মিয়াকে যে গফুর শেষ খেয়ার উপর শেষ সাক্ষাতের দিনে আধখানা পাটালি দিয়েছিল তাও বাদ গেলনা বলতে। এবার আশ্বস্ত হলো মনু মিয়া। কিন্তু গফুরের এই বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সে।
গফুর বলল- তোমার ভাই হারু মিয়া কোথায়? তাকে তো দেখছি না।
“এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে হারু। কয়েক বছর আগে ভয়ঙ্কর এক বানের স্রোতে পশ্চিমের ঐ বাঁকটায় ডিঙ্গি উল্টে জলে ডুবে মারা যায় সে। পরদিন সকালে তার লাশ ওপারের চরে ভেসে উঠে।” বলতে বলতে ছলছল করে উঠলো মনু মিয়ার চোখ। ঘাটের উপরের উঁচু টিবিটার উপর রয়েছে তার কবর।
একদিন জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসা গফুরকে যে দু’টি ভাই এই নদী হতে তুলে প্রাণ বাঁচিয়েছিল সেই নদী আজ তার প্রাণ রক্ষকের প্রাণ সংসার করেছে। যে নদী জলে ডিঙ্গি বেয়ে গোটা জীবন কেটে গেছে হারু মাঝির সেই নদী জল তাকে ডুবিয়ে মেরেছে। পড়ে যাওয়া আকাশের উঁচু মেঘের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে কথা গুলো ভাবছে গফুর।
চৈতন্যের পালে হাওয়া লাগলো গফুরের। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে- “তোমার নৌকা কোথায়” জানতে চাইলেন গফুর সাহেব।
কলের নৌকা আমদানির পর থেকে দাঁড়ের নৌকায় আর কেউ উঠতে চায়না বলল মনু নিয়া।
গফুর সাহেব তার টাকার থলি হতে কয়েক বান্ডিল টাকা বের করে দিলেন মনু মিয়ার হাতে। এগুলো গ্রহণে সংকোচবোধ করল মনু মিয়া। গফুর সাহেব বলল-এগুলো রাখো তোমার জন্য এনেছি।
গফুর সাহেবের দেওয়া টাকা দিয়ে একখানা বড় কলের নৌকা কিনল মনু মিয়া। ঘাটের সবচেয়ে বড় নৌকা খানা এখন তার। এককালের বইঠা বাওয়া ডিঙ্গি নৌকার মাঝি এখন কলের নৌকার মালিক। আজ মনে অনেক খুশি তার। নৌকা বোঝাই যাত্রী নিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করে নদীর স্রোতের আগে বহুদূর চলে গেল মনু মিয়া।